প্রশ্নোত্তরঃ বাঙালিকে সংকর জাতি বলা হয় কেন? অথবা, "বাঙালি একটি সংকর জাতি।"- ব্যাখ্যা কর। অথবা, বাঙালি স্বতন্ত্র না কি সংকর জাতি?
ভূমিকাঃ বাঙালি নরগোষ্ঠী বহুকাল ধরে বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে। কালের গতি ধারায় বিভিন্ন জাতি বর্ণের রক্তপ্রবাহ বাঙালি জাতির ধমনীতে প্রবাহিত হয়েছে। এ কারণে অনেক নৃবিজ্ঞানী বাঙালি জাতিকে সংকর জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বাঙালি কে সংকর জাতি বলার কারণঃ র্দীঘকাল বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীতে বিভক্ত হয়ে এ আদি মানুষেরা বঙ্গের বিভিন্ন জায়গায় বসবায়া শুরু করে৷ এসব জনগোষ্ঠী একে অপরের সাথে মিশ্রিত হয় শতকের পর শতকব্যাপী। মনে করা হয়, আদি অস্ট্রেলীয়রাই বাংলার প্রাচীনতম বাসিন্দা। বাংলাদেশের সাঁওতাল, রাজবংশী প্রভৃতি আদি অস্ট্রেলীয়দের সাথে সম্পৃক্ত। বাংলাদেশের জলপ্রবাহে মঙ্গোলীয়দের রক্তেরও পরিচয় পাওয়া যায়। পারস্য জাতি ভারতবর্ষে আগমনের ফলে বাঙালির রক্তে নতুন মিশ্রণ ঘটে। অনেকের ধারণা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর উপর আর্যদের প্রভাব রয়েছে। ব্রাহ্মণ, বৈদ্য ও কায়স্থদের মধ্যে এদের প্রভাব কম-বেশি লক্ষ করা যায়। নৃবিজ্ঞানী হটন উপমহাদেশের জনগোষ্ঠীকে যে ৮ ভাগে বিভক্ত করেছেন সেগুলোর মধ্যে আলপাইন একটি। তিনি বলেছেন, আলপাইন মানব গোষ্ঠীর সাথে বাঙালি জনগোষ্ঠীর অনেক দৈহিক মিল আছে। মূলত আলপাইন আর্যভাষী ইন্দো-ইরানী গোষ্ঠী। ঐতিহাসিক যুগে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এবং ভারতের বাহির থেকে আসা বিভিন্ন অভিযাত্রী বাঙালি জাতি নির্মাণে অবদান রাখে। গুপ্ত, সেন, বর্মন, খড়গ,তুর্কি, আফগান, মুঘল, পর্তুগিজ, ইংরেজ ও আর্মেনীয় প্রভৃতি বহিরাগত জাতি শাসন করেছে বঙ্গ অঞ্চল এবং রেখে গেছে তাদের রক্তের ধারা। ইন্দোচীন থেকে নেগ্রিটোরা বাংলায় প্রবেশ করে। নেগ্রিটোদের উৎখাত করে বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক জাতি। এরপর দ্রাবিড় বাংলায় প্রবেশ করে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড় জাতির সাথে আর্য জাতি বাংলায় প্রবেশ করে গড়ে উঠেছে বাঙালি জাতি। এভাবে বাংলায় আর্য জাতির সাথে অন্যান্য জাতি মিশ্রিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সংকর জাতি। তাই বাঙালি জাতি কোনো স্বতন্ত্র জাতি নয়, বরং সংকর জাতি।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, বাংলায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর আগমন ঘটে। কালের পরিক্রমায় বৈচিত্র্যময় পরিবেশে ভিন্ন ভিন্ন নরগোষ্ঠীর সাথে মেলামেশার ফলে বাঙালিরা একটি সংকর জাতিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বাঙালি জাতির নেগ্রিটো, অস্ট্রিক, দ্রাবিড়, আর্য, মঙ্গোলীয়, সেমীয় ইত্যাদি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর রক্তধারার সংমিশ্রণে একটি বিচিত্র জাতি। বাঙালির দৈহিক বৈশিষ্ট্য অবলোকন করলে বোঝা যায় যে একই দেশের বিভিন্ন অংশে ভিন্ন ভিন্ন জনগোষ্ঠীর পরিচয় বহন করেছে।
Comments