প্রশ্নোত্তরঃ হযরত মুহাম্মদ (স) এর মদিনায় হিজরতের কারণ ও ফলাফল আলোচনা কর। অথবা, হযরত মুহাম্মদ (স) এর মদিনায় হিজরতের কারণ কি ছিল? এর ফলাফল উল্লেখ কর। অথবা, হিজরতের চারটি কারণ লিখ?
ভূমিকাঃ নবুয়ত প্রাপ্তির পর ১২ বছর হযরত মুহাম্মদ (স) মক্কায় অবস্থান করে ইসলাম প্রচার করে। কিন্তু এ সময়ে ইসলামের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সাধিত হয়নি। ৬২২ খ্রিস্টাব্দে বিধর্মী কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা যখন বৃদ্ধি পায় তখন মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নিকট হতে মদিনায় হিজরতের প্রত্যাদেশ বা ওহি লাভ করে, মদিনার পথে হিজরত করেন।
হিজরতের কারণঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) নবুয়তের ১২ বছর পর ৬২২ খ্রিস্টাব্দে মাতৃভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। তার এই হিজরতের পিছনে বেশ কিছু কারণ ছিল।
১. আকাবার শপথঃ আকারবার শপথ কালে হযরত মুহাম্মদ (স) ইয়াসরীবের কিছু সংখ্যক লোককে ইসলামে দীক্ষিত করেন। তাদের অনুপ্রেরণায় মহানবী (স) হিজরতের সিদ্ধান্ত নেন।
২. আউস ও খাযরাজ গোত্রে আহবানঃ মদিনার আউস ও খাযরাজ গোত্রদ্ব্যয়ের মধ্যে বিরোধ ছিল। তাদের মধ্যে কয়েক বছর ধরে বুয়াসের যুদ্ধ চলছিল। তারা এমন এক ব্যক্তিত্বকে খুজছিল যে তাদের মধ্যে শান্তি স্থাপন করতে পারে। মুহাম্মদ (স) এর মধ্যে এ গুণের সন্ধান পেয়ে তারা মুহাম্মদ (স) কে সাদরে আমন্ত্রণ জানায়।
৩. হত্যার ষড়যন্ত্রঃ কুরাইশরা যখন দেখল, ইসলাম দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং মহানবী (স) এর সঙ্গী সাথী অনেকে ইয়াস্রীব ও আবিসিনিয়ায় হিজরত করে চলে গেছে তখন তারা হযরত মুহাম্মদ (স) কে হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। অতঃপর আল্লাহর আদেশ পেয়ে নবী (স) হিজরতের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
৪.আত্মিক সম্পর্কঃ মদিনার সাথে হযরত মুহাম্মদ (স) এর আত্মিক সম্পর্ক ছিল। তার পিতা আব্দুল্লাহ ও প্রপিতামহ হাশিম মদিনায় বিয়ে করেন। এ কারণে মদিনাবাসিদের সাথে তার রক্তের সম্পর্ক ছিল।
৫. ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাতঃ হযরত মুহাম্মদ (স) নবুয়ত লাভের পর তার একত্ববাদ কুরাইশদের শতশত বছরের জড়বাদী ধর্মীয় বিশ্বাসের মূলে আঘাত করে। ফলে মক্কাবাসীদের ইসলামের বিরোধিতা মুহাম্মদ (স) কে মক্কা ত্যাগে বাধ্য করেছিল।
৬. আল্লাহর প্রত্যাদেশলাভঃ বিধর্মী কুরাইশদের অত্যাচারের মাত্রা যখন বৃদ্ধি পায় তখন মুহাম্মদ (স) আল্লাহর নিকট হতে মদিনায় হিজরতের প্রত্যাদেশ বা ওহি লাভ করেন।
হিজরতের ফলাফল ও গুরুত্বঃ মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) এর হিজরত দেশত্যাগের সামান্য ঘটনা নয়। ইসলামের ইতিহাসে এর ফলাফল ও গুরুত্ব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ।
১. সফলতার সূচনাঃ হিজরত হযরত মুহাম্মদ (স) এর জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। হিজরতের ফলে তার মক্কা জীবনের অত্যাচার, লাঞ্চনার অবসান ঘটে, অন্যদিকে তিনি প্রভূত সম্মান ও সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব লাভ করেন।
২. সামাজিক ক্ষেত্রেঃ মদিনায় হিজরতের ফলে মহানবী হযরত মুহাম্মদ (স) সমাজসংস্কাক হিসেবে আবির্ভূত হন। সমাজের নানা অনাচার দূর করে একটি সুশৃঙ্খল সমাজ প্রতিষ্ঠা করেন। বিবাহ, তালাক, দাসত্ব প্রথা, উত্তরাধিকার আইন, পারিবারিক আইনকানুন ইত্যাদি প্রবর্তন করেন। তিনি এখানে মুসলিম উম্মাহ বা সমাজ সুযোগ পেলেন।
৩. হিজরি সনের প্রবর্তনঃ হযরত মুহাম্মদ (স) এর হিজরতকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য রাসূলের ওফাতের সাত বছর পর হযরত ওমর (রা) হিজরি সন প্রবর্তন করেন।
৪. রাষ্ট্রপ্রধানঃ মক্কায় হযরত মুহাম্মদ (স ল ছিলেন একজন ধর্ম প্রচারক মাত্র কিন্তু তিনি ধর্মপ্রচারের পাশাপাশি রাষ্ট্র পরিচালনারও গুরুদায়িত্ব পালন করেন।
৫. ধর্মীয় রাষ্ট্রপ্রতিষ্ঠাঃ হিজরতের ফলে মদিনায় ধর্ম প্রচারের সাথে সাথে ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়।
৬. ইসলামের পূর্ণতাঃ ইসলামের মৌলিক বৈশিষ্ট্য ও নীতি মক্কায় অবতীর্ণ হলেও মদিনায় হিজরত করার পর তা সংগঠিত ধর্ম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। মক্কায় ইসলাম শুধু একটি ধর্মই ছিল। কিন্তু মদিনাতে এসে তা সমাজ ও রাষ্ট্র পদ্ধতি হিসেবেও স্বীকৃতি হলো।
৭. সংবিধান প্রণয়নঃ মদিনায় বসবাসরত সম্প্রদায়সমূহের মধ্যে ঐক্য, সম্প্রীতি ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য মহানবী (স) ৬২৪ খ্রি. লিখিত যে চুক্তি বা সনদ প্রণয়ন করেন তা মদিনা সনদ (The Charter of Madina) নামে পরিচিত।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায়, ইসলামের ইতিহাসে হিজরতের ফলাফল ও গুরুত্ব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। হিজরতের ফলে মহানবীর মক্কা জীবনের অত্যাচার, লাঞ্চনার অবসান ঘটে, অন্যদিকে তিনি প্রভূত সম্মান ও সর্বক্ষেত্রে নেতৃত্ব লাভ করেন।
Comments